তিলে তিলে তৈরি স্বপ্ন এক গুলিতেই শেষ

ফুটপাতে পেয়ারা বিক্রি করে ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়েছি। পলিটেকনিকে ভর্তি করিয়েছি। ছেলে আমার গেলো ঢাকায় ইন্টার্ন করতি আর ফিরল লাশ হয়ে। আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। আমি কারো কাছে কিচ্ছু চাইনে, ওরা কী আমার ছেলেরে ফিরাই দিতি পারবিনে? এভাবেই বিলাপ করছিলেন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা শহরের থানাপাড়া এলাকার বাসিন্দা শরীফ উদ্দিন।

গত ১৯ জুলাই কোটা আন্দোলনে রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় গুলিতে প্রাণ হারায় তার একমাত্র ছেলে মারুফ হোসেন। কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে সবেমাত্র পড়ালেখা শেষ করেছেন তিনি। ইন্টার্ন করতে হবে তাকে। তাই গত ১ জুলাই ঢাকায় পাড়ি জমান। কয়েকজন বন্ধু মিলে ভাড়ায় উঠেন বনশ্রী এলাকায় একটি বহুতল ভবনে। এরই মধ্যে শুরু হয় কোটা আন্দোলন। আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। সেদিন ছিল ১৯ জুলাই শুক্রবার। গোটা রাজধানীজুড়ে অস্থিরতা, সংঘর্ষ। কৌতুহলচিত্তে দুপুর আড়াইটায় বন্ধুদের সঙ্গে বের হয়েছিলেন সেই চিত্র দেখার জন্য। বাসার সামনেই চলছিল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ। বিজিবি সদস্যদের একটি সাজোয়া বহর ধাওয়া দেয় আন্দোলনকারীদের। ওই সময় মারুফ ও তার বন্ধুরাও দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পেছন থেকে ছোঁড়া গুলিতে মারুফ লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়া হলে বাঁচানো যায়নি তাকে। সোমবার দুপুরে মারুফের বাড়িতে গেলে দেখা মেলে এক অন্যরকম আবহ। ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি কেউই। শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন মা ময়না খাতুন। একমাত্র বোন মাইশা পাশেই বসে রয়েছে। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে মাইশা। তাই ভাই হারানোর যে শূন্যতা খুব একটা বুঝে ওঠার মত মানসিকতা জন্মেনি। সে জানায় ওরা আমার ভাইয়াকে গুলি করে মাইরি ফেলিছে। ভাইয়া আমাকে অনেক আদর করত, আমাকে ডাক্তার বানাবেন বলেছিলেন। এটুকু বলেই চলে যায় পাশের বাড়িতে।

প্রায় ১০ দিন চুলায় আগুন জ্বলেনি। প্রতিবেশীরাই পালা করে খাবার যোগান দেন। টানা ১০ দিন পর এই প্রথম রান্না হয়েছে সোমবার। মারুফের মা ময়না খাতুন একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। খুব একটা কথাও বলেন না কারো সঙ্গে। শুধুমাত্র চেয়ে থাকেন শূন্য দৃষ্টিতে। কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন তিলে তিলে তৈরি করেছিলাম স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। ওই স্বপ্নকে বাঁচতে দেয়নি ওরা। গুলি করে আমার স্বপ্নকে শেষ করে দিয়েছে। তিনি জানান খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্ট করে আমার ছেলেকে মানুষ করেছিলাম। আজ সেই ছেলে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। সরকারের কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। আমিতো আমার ছেলেকে চাই, সরকার কী আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? পাশেই অঝোরে কাঁদছিলেন মারুফের দাদি। কোলে-পীঠে করে মানুষ করেছেন তিনি। সেই আদরের নাতিই আমাদের মাঝ থেকে চলে গেলো! আমরা এখন আর কি নিয়ে বাঁচব।
প্রতিবেশী রাখি খাতুন মারুফকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার মত ছেলে আশপাশ এলাকায় মেলা ভার। পরিবারের একমাত্র সম্বল ছিল সে। তার এমন করুন পরিণতি সব কিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। গত ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে কর্মে যেতে পারেননি বাবা শরীফ উদ্দিন। তাই দুপুরে বাড়িতেও আসেননি। তার একমাত্র ব্যবসা হলবাজারের পোস্ট অফিসের পাশে ফুটপাতে পেয়ারা বিক্রি। এমন পরিস্থিতিতে সোমবার আবার ব্যবসায়ে ফিরেন তিনি। বাজারে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। ছেলের কথা জানতেই কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছি। ছেলেকে কোনো অভাব বুঝতে দিইনি। সেই ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। তিনি জানান ১৯ জুলাই তার সঙ্গে ছেলের শেষ কথা হয়। ঢাকায় মারামারি হচ্ছে, বাসা থেকে যেন বের না হয় সেই পরামর্শ দেন তিনি। অথচ বিকেলেই খবর আসে আমার ছেলে মারা গেছে। তিনি আরও জানান, মারুফ ঢাকায় যাওয়ার পর ফোন করে বলে আব্বু তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। কষ্টের দিন শেষ হয়ে যাবে। আমি চাকরি পেয়ে যাবো। মারুফের বাবা শরীফ উদ্দিন জানান, কারো কাছে আমার চাওয়ার নেই। ওরা তো আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না? গত ২০ জুলাই সকালে মারুফের মরদেহ আসে বাড়িতে। পৌর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে পৌর কবরস্থানেই দাফন করা হয় মারুফকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *