বাবা অসুস্থ! রাতে মুঠোফোনে ছেলে মামুন মিয়াকে বিষয়টি জানায় মা হেনা বেগম। মামুন মাকে কথা দিয়েছিলেন, সকালে ফিরেই বাবাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন তিনি। হ্যাঁ, সে বাড়িতে ফিরে এসেছিলো ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। মামুনের এভাবে ফিরে আসাটা কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় একটি বুলেট নিভিয়ে গেছে এই স্বপ্নবাজ তরুণের জীবন প্রদীপ। তার এমন মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৌলপাড়া ইউনিয়নের চরচিকন্দি এলাকার আব্দুল আব্দুল গণি মাদবর ও হেনা বেগম দম্পতির চার ছেলের মধ্যে সবার ছোট মামুন মিয়া (২৫)। ছোট বেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী এই কৃষক পরিবারের ছেলেটি। তার স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। ২০১৬ সালে স্থানীয় শৌলপাড়া মনোয়ার খান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৮ সালে শরীয়তপুর জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজে ভর্তি হন। সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকোত্তরের পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যাঞ্চার হিসেবে কাজ করতেন। নিজের খরচ যোগানোর পাশাপাশি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরিবারেরও। তার স্বপ্ন পূরণ করতে চাকরি নিয়ে ২২ আগষ্ট মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজ যাওয়ার কথা ছিল তার। তবে তার স্বপ্ন যে অধরাই রয়ে গেল। বুলেটের আঘাতে নিভে গেলো তার জীবন প্রদীপ।
প্রত্যক্ষদর্শী পারভেজ জানায়, তিনি আর মামুনসহ বেশ কয়েকজন ঢাকার রামপুরা ওয়াবদা রোড এলাকায় একটি ভাড়ার বাসায় থাকতেন। গত ১৮ জুলাই রাত ১২টার দিকে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেলে বাসা থেকে নিচে নেমে আসেন ৫ বন্ধু। এরপর তারা কিছুক্ষণ গলির মধ্য দিয়ে হাটাহাটি করেন। একসময় মামুন তাদের থেকে একটু সামনে হেটে ঠিক গলির মাথায় চলে যায়। আর কিছুক্ষণ পর বিজিবির একটি গাড়ি থেকে চালানো হয় গুলি। দৌঁড়ে পালাতে যাওয়ার সময় একটি বুলেট তার মাথায় ঢুকে বের হয়ে যায়। এরপর তার বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরো সায়েন্স ও হাসপাতালে নিয়ে যান। পরের দিন শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মামুনের বড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠোন ভর্তি এলাকার মানুষ। মা হেনা বেগম ঘরের বারান্দার একটি খুটি ধরে আহাজারি করেছিলেন। তাকে শান্তনা দিতে ছুটে এসেছেন প্রতিবেশীরা। বাবা আব্দুল গণি মাদবর অসুস্থ। একটু কান্না করতেই আবার নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন।
আহাজারি করতে করতে মামুনের মা হেনা বেগম বলেন, আমার পোলায় কইছিলো সকালে আইসা ওর বাপেরে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাইবো। কিন্তু আল্লাহ এইডা কি করলো। আমার পোলায় যে লাশ হইয়া ফিরলো। আমি কীভাবে আমার বাপরে ভুলমু। মামুনের বড় ভাই রুবেল বলেন, মামুন অনেক মেধাবী ছিল। ও নিজের প্রচেষ্টায় এতোদূর এসেছে। নিজে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে কাজ করে রোজগার করতো। ওর আয়ের উপর আমাদের পরিবার নির্ভরশীল ছিল। এখন আমাদের পরিবারটা কীভাবে চলবে জানিনা। আমার ভাইয়ের মতো এমন মৃত্যু যেন আর কারো না হয়, সরকারের কাছে এটাই দাবী। মামুন মিয়ার প্রতিবেশী তামান্না আক্তার বলেন, মামুন কাকার ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি অনেক টান ছিলো। তার আগ্রহ দেখে পরিবারের সবাই মিলে পড়াশোনা করায়। সে আমাদের এলাকার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সেকেন্ড পজিশন মার্ক পেয়ে এসএসসি পাশ করে। সে পড়াশোনা করে আজ অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলো। কয়েকদিনের মধ্যে তার আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তার মৃত্যুতে পরিবারটি পথে বসে গেলো।শৌলপাড়া মনোয়ার খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোতালেব হোসেন বলেন, মামুন ছেলেটি মেধাবী ছিল। কয়েক দিন আগে আমার সাথে দেখা হয়েছিলো, তখন আমাকে জানায় ও কিছুদিনের মধ্যে বেলিজ যাচ্ছে। ওর এমন মৃত্যু মেনে নেয়ার মতো না। শৌলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খান বলেন, ছেলেটি ওর সফলতার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিলো। আর কিছুদিন পরে ওর পরিবারের আর কষ্ট থাকতো না। এমন মৃত্যু মেনে নেয়ার মতো না। আমি সব সময় আমার সাধ্যমত পরিবারটির পাশে থাকার চেষ্টা করবো।